গ্যাস সংকটে ১২ ঘণ্টা বন্ধ থাকছে শিল্প-কারখানা

গ্লোবালবিজ ডেস্ক

চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস পাচ্ছে না দেশের অন্যতম শিল্পাঞ্চল গাজীপুর ও ময়মনসিংহের কারখানাগুলো। ওই এলাকায় থাকা একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ করায় পরিস্থিতি আরো সংকটপূর্ণ হয়ে উঠেছে বলে অভিযোগ শিল্পমালিকদের। এ অবস্থায় দুই শিল্প এলাকায় কারখানাগুলো দিনে ১২ ঘণ্টার মতো বন্ধ রাখতে হচ্ছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহের উদ্দেশ্যে বসানো কম্প্রেসারের পরিবর্তন চেয়ে এরই মধ্যে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর কাছে চিঠি দিয়েছে বস্ত্র খাতের মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ)।

শিল্পমালিকরা চিঠিতে জানিয়েছেন, ময়মনসিংহের শম্ভগঞ্জে ২১০ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ করায় দিনে ১২ ঘণ্টা কারখানা বন্ধ রাখতে হচ্ছে। সন্ধ্যা ৬টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত বস্ত্র খাতের অধিকাংশ কারখানা গ্যাস সংকটে বন্ধ থাকে। গ্যাস না পাওয়ায় এরই মধ্যে ওই অঞ্চলের অনেক শিল্প-কারখানার উৎপাদন বন্ধ হতে চলেছে।

জানা গিয়েছে, শম্ভুগঞ্জে রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (আরপিসিএল) একটি ডুয়াল ফুয়েল চালিত ২১০ মেগাওয়াট সক্ষমতার কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্লান্ট রয়েছে। ২০০৭ সাল থেকে উৎপাদনে রয়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। আরপিসিএলের এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটির কারণে বর্তমানে রাতে শিল্পাঞ্চলের গ্যাস সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ থাকছে। এতে ওই অঞ্চলে অন্তত পাঁচ শতাধিক শিল্প-কারখানার নাইট শিফটে উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে বলে জানিয়েছেন শিল্পমালিকরা।

বিদ্যুৎ বিভাগে দেয়া চিঠিতে বিটিএমএ জানিয়েছে, অব্যাহতভাবে গ্যাস সংকটের মধ্যে আরপিসিএলের বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালু করায় গাজীপুর, শ্রীপুর ও ময়মনসিংহের ভালুকা এলাকায় বস্ত্রশিল্পের প্রতিষ্ঠানগুলো তীব্র আকারে গ্যাস সংকটে পড়েছে। মূলত আরপিসিএলের বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহের জন্য ২৫০ পিএসআই চাপের একটি কম্প্রেসার বসানো হয়েছে। ফলে ওই অঞ্চলের শিল্প-কারখানাগুলো পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ পায় না। বিদ্যমান কম্প্রেসারটি প্রতিস্থাপন করে ১৫০ পিএসআই চাপের কম্প্রেসার বসালে বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহের পর যে গ্যাস সাশ্রয় হবে তা সরবরাহ করা হলে শিল্প-কারখানাগুলো সচল রাখা সম্ভব হবে বলে মনে করছে বিটিএমএ।

তবে আরপিসিএল বলছে, গ্যাসই যেখানে ঠিকমতো পাওয়া যায় না, সেখানে কম্প্রেসার চালানোর প্রশ্নই আসে না। আগে গ্রিডে যে চাপে গ্যাস আসত, তা কম্প্রেসারের মাধ্যমে কিছুটা হলেও বেশি সরবরাহ পাওয়া যেত। এখন সেটিও সম্ভব হচ্ছে না। বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য শিল্প-কারখানা বন্ধ থাকছে বিষয়টি এমন নয়। বরং শিল্প খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে রাতের বেলায় বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাচ্ছে আরপিসিএল। গ্যাস সংকটের কারণেই বিদ্যুৎ উৎপাদনে রাতকে বেছে নেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) তথ্যমতে, ২১০ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ২৬ অক্টোবর দিনের বেলায় ১০৫ ও রাতে ৮৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে। অর্থাৎ সক্ষমতার অর্ধেক উৎপাদন করছে কেন্দ্রটি। আরপিসিএল বলছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পূর্ণ সক্ষমতায় চালাতে হলে কেন্দ্রে দৈনিক ৪০ এমএমসিএফ গ্যাসের প্রয়োজন। যদিও সর্বনিম্ন ১০ থেকে সর্বোচ্চ (রাতে) ২৮ এমএমসিএফ পর্যন্ত পাওয়া যায়। এ গ্যাস দিয়ে ১৫০ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় না।

আরপিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবদুস সবুর বণিক বার্তাকে বলেন, শিল্পের প্রাধান্য বিবেচনায় নিয়েই বিদ্যুৎ উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। গ্যাস সংকটের কারণে দিনে এক-চতুর্থাংশ এবং রাতে সক্ষমতার অর্ধেক বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছি। ফলে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য শিল্প এলাকায় গ্যাস পাওয়া যায় না এটি সঠিক নয়। বরং সন্ধ্যায় অনেকগুলো শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে রাতে কেন্দ্রগুলো চালিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখা হচ্ছে।

তিনি বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রটি যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে তা ময়মনসিংহ, গাজীপুর, ভালুকা ও মাওনা শিল্প এলাকায় সরবরাহ করে। ফলে ওই অঞ্চলের জন্য এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালু রাখাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

সংশ্লিষ্টরা জানান, আরপিসিএলের বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু থাকায় গাজীপুরসহ আশপাশের এলাকায় গ্যাসের চাপ পায় না শিল্প-কারখানাগুলো। বিদ্যুৎকেন্দ্রে ২৫০ পিএসআই প্রেসারে গ্যাস দেয়ায় সন্ধ্যা ৬টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত শিল্প এলাকায় গ্যাস সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ রাখে বিতরণকারী প্রতিষ্ঠান।

বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বণিক বার্তাকে বলেন, এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি। কীভাবে এটি সমাধান করা যায় তা নিয়ে মন্ত্রণালয় কাজ করছে বলে আমাদের জানানো হয়েছে। আরপিসিএলের ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য গাজীপুর, শ্রীপুর ও ভালুকা অঞ্চলে গ্যাস সরবরাহ ১২ ঘণ্টা বন্ধ থাকছে। ফলে ওখানকার শিল্প-কারখানাগুলো গ্যাস সরবরাহ না পাওয়ায় রাতে কারখানা চালু রাখতে পারছে না। আমাদের রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রার বিষয়টিও চিঠিতে জানিয়েছি। একই সঙ্গে শিল্পমালিকরা কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সেটিও বলেছি, সমাধান কী হতে পারে সেটাও বলা আছে।

আরপিসিএল সূত্রে জানা গিয়েছে, শম্ভুগঞ্জের ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে গ্যাস সরবরাহে গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল) ধনুয়া এমএমএস থেকে ময়মনসিংহ টিবিএস পর্যন্ত ৬০ কিলোমিটার গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণ করেছে।

দেশে জ্বালানি সংকটে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা কমিয়েছে সরকার। তবুও শিল্পে গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা যাচ্ছে না। গ্যাস সংকটের তীব্রতাও বাড়ছে। এরই মধ্যে সম্প্রতি বিষয়টির সমাধান চেয়ে একটি সংবাদ সম্মেলন ও সেমিনারের আয়োজন করেছেন শিল্পমালিকরা। তাদের দাবি, দেশের শিল্প বাঁচাতে যেকোনো মূল্যেই গ্যাস সরবরাহ বাড়াতে হবে। এমনকি উচ্চমূল্যের কারণে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধ থাকলেও বেশি মূল্যে হলেও তা আমদানি করার অনুরোধ জানানো হয়েছে। আমদানিতে যে বাড়তি মূল্য পড়বে, সেটিও দেয়ার কথা জানিয়েছেন মালিকরা। তবে সরকারের পক্ষ থেকে আশাব্যঞ্জক কোনো সাড়া পাননি তারা।

এদিকে, গতকালও বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন বোর্ডে (বিডা) আয়োজিত এক সভায় শিল্প-কারখানায় নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিতের বিষয়টি তুলে ধরেন ব্যবসায়ীরা। সেখানে তারা বেশি মূল্যে হলেও গ্যাস আমদানি করে তা শিল্পে সরবরাহ করার অনুরোধ জানিয়েছেন। ওই মতবিনিময় সভায় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানিয়েছেন, শিল্পে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়ানোর চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। একই সঙ্গে গাজীপুর, আশুলিয়া ও নারায়ণগঞ্জে শিল্পের চাপজনিত যে সমস্যা তা দ্রুত সমাধানের চেষ্টা চলছে।

Leave A Reply

Your email address will not be published.