সর্বজনীন পেনশন তহবিল
বিরোধীরা কেন আপত্তি করছে

গ্লোবালবিজ ডেস্ক
দেশের কর্মক্ষম সব মানুষকে পেনশন সুবিধার আওতায় নিয়ে আসার জন্য বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করার একটি আইন পাশ করেছে । যেসব নাগরিকের জন্য কোন পেনশন ব্যবস্থা চালু নেই, ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী সেই নাগরিকরা এই স্কিমে অংশ নিতে পারবেন এবং ৬০ বছর বয়স হওয়ার পর থেকে পেনশন সুবিধা পাবেন।

সরকারের বিলটি পাস হওয়ায় সবার জন্য পেনশন কর্মসূচী চালু করার আইনি ভিত্তি তৈরি হলো। এখন কর্তৃপক্ষ এবং বিধিমালা তৈরি করে পেনশন ব্যবস্থা চালু করতে পারবে।

কিন্তু ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা বিল-২০২২’ নামের এই বিলের সমালোচনা করে বিরোধীরা বলছে, এই বিল অনেকটা ব্যাংকের ডিপিএসের মতো হয়ে গেছে। এখানে সরকারের অংশগ্রহণ কী হবে, তা পরিষ্কার হয়নি। পেনশন তহবিলে জমা টাকার ব্যবহার নিয়েও তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু সর্বজনীন পেনশন তহবিল নিয়ে কেন আপত্তি করছে বিরোধীরা? এই ফান্ডের ভবিষ্যৎ কী হতে পারে?

কেন আপত্তি?
জাতীয় সংসদে বিরোধী জাতীয় পার্টির একজন সংসদ সদস্য মুজিবুল হক বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘’আইনের উদ্দেশ্য নিয়ে আমাদের কোন আপত্তি নেই। এরকম একটি আইন হলে মানুষ উপকৃত হবে। কিন্তু এখন যেভাবে আইনটি প্রস্তাব করা হয়েছে, তাতে কিছু সমস্যা আছে। যেমন বলছে, একজন টাকা জমা দিয়ে যাবে, পরে সে ইন্টারেস্টসহ টাকা ফেরত পাবে। কিন্তু সরকার কী পরিমাণ টাকা দেবে, সেটা তো সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয় নাই।‘’

‘’আমার টাকার ওপরেই যদি ইন্টারেস্ট দেয়া হয়, সেটা তো ব্যাংকে রাখলেও আমি পাবো। সেটা তো ডিপিএসের (ডিপোজিট পেনশন স্কিম) মতো হয়ে গেল। তাহলে সরকারের এই তহবিলে টাকা দিয়ে কী লাভ হবে। আমি টাকা জমা দিলে, সেখানে সরকার কত টাকা দেবে, জনগণ কী বেনিফিট পাবে, সেটা তো সুনির্দিষ্ট করে বলা নাই।‘’

আইনটি সংসদে পাশ হলেও পেনশনের জন্য কীভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হবে, চাঁদার হার কি হবে, সেসব বিষয় এখনো ঠিক করা হয়নি।

যদিও সরকার বলছে, পরবর্তীতে যে বিধিমালা তৈরি করা হবে, সেখানে এসব বিষয় উল্লেখ করা হবে। কিন্তু মি. হক বলছেন, বিধিমালা তো যেকোনো সময় পরিবর্তন হতে পারে। বরং এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ আইনে এই বিষয়টির উল্লেখ থাকার দরকার ছিল।

দেশের কর্মক্ষম সব মানুষকে পেনশন সুবিধার আওতায় নিয়ে আসার জন্য বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করার একটি আইন পাশ করেছে ।

আইন হওয়ার পর এখন জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ তৈরি করবে সরকার। এই কর্তৃপক্ষ পেনশন ব্যবস্থা চালু করা ও ব্যবস্থাপনার কাজ করবে। এই বিলটি সংসদে উত্থাপনের পরে আপত্তি তুলেছিলেন আরও কয়েকজন সংসদ সদস্য।

স্বতন্ত্র এমপি রেজাউল করিম সংসদে বলেছেন, ‘’সরকারি চাকুরীজীবীরা ৩২-৩৫ বছর চাকরি করেও পেনশন পাচ্ছেন না। অনেক চাকুরীজীবী আছেন, যারা বছরের পর বছর জুতার তলা ছিঁড়ে ফেলছেন, কিন্তু পেনশন পাচ্ছেন না। আর সাধারণ মানুষ, তারা কি সত্যি ৬০ বছর বয়সে গিয়ে জীবনের এসব সঞ্চয় তুলতে পারবেন?’’

জাতীয় পার্টির আরেকজন সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম বিলটিকে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক দাবি করে বলেন, ‘’সংবিধানে বলা হয়েছে যে, বেকারত্ব, ব্যাধি বা পঙ্গুত্বজনিত, বৈধব্য, পিতৃমাতৃহীন বা বার্ধক্যজনিত কারণে সরকারি সাহায্য লাভের অধিকার মানুষের সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার। কিন্তু এখানে মানুষের কাছ থেকে চাঁদা নিয়ে সরকার আবার ফেরত দেবে।‘’

গণফোরামের সংসদ সদস্য মোকাব্বির খান বলেছেন, ”এটি একটি চমৎকার উদ্যোগ, কিন্তু এই পেনশন ব্যবস্থায় জনগণের সাড়া পাওয়া যাবে না। কারণ সরকারি চাকরিজীবীরা যেভাবে পেনশন পান, তার সঙ্গে এখানে অনেক কিছুই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এটি অনেকটা ব্যাংকিং প্যাকেজের মতো।”
জাপার আরেকজন এমপি শামী হায়দার পাটোয়ারি বলেছেন, ”আপাতদৃষ্টিতে আইনটি ভালো। কিন্তু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রভিডেন্ট ফান্ড যেভাবে দেয়া হয়, এটি তার বাইরে কিছু বলে মনে হয় না। কারণ সরকার কী মুনাফা দেবে তা পরিষ্কার নয়।”

তবে এসব সমালোচনার জবাবে বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সংসদে বলেছেন, বিলটি আনার আগে অনেক আলোচনা হয়েছে। আইন হওয়ার পরে আপনারা যখন ইচ্ছা সেটা সংশোধন করার সুযোগ পাবেন। আমি মনে করি, এটার ওপরে আর জনমত যাচাই-বাছাই করার কোন প্রয়োজন নেই।‘’ পরে সংসদে কণ্ঠ ভোটে বিলটি অনুমোদন দেয়া হয়।

বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন
বাংলাদেশে বেসরকারি চাকরিজীবীদের পেনশনের আওতায় আনার কোন উদ্যোগ এটাই প্রথম। যে বিপুল জনগোষ্ঠীকে উদ্দেশ্য করে আইনটি করা হয়েছে, সেটা বাস্তবায়িত হলে এটাই হবে দেশের সবচেয়ে বড় পাবলিক ফান্ড।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশে ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী মানুষের সংখ্যা প্রায় সাড়ে আট কোটি। এর মধ্যে সরকারি চাকরিজীবী রয়েছেন ১৪ লাখের কিছু বেশি।
সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু হলে প্রায় আট কোটি ৩৫ লাখ মানুষ এই ব্যবস্থার আওতায় আসবে।
বাংলাদেশের বেসরকারি একটি তহবিল ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান, অ্যাসেট অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ম্যানেজমেন্ট সার্ভিসেস অফ বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইয়োওয়ার সাঈদ বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘’সরকার কিভাবে এই তহবিলটি ব্যবস্থাপনা করবে, সেটার ওপরে অনেক কিছু নির্ভর করে। বিশেষ করে কোথায় কীভাবে বিনিয়োগ করা হবে, তাতে কতটা রিটার্ন পাওয়া যাবে, এসবের ওপরে ফান্ডের সাফল্য নির্ভর করবে।‘’
সাধারণত যেকোনো তহবিল বাড়াতে বন্ড, স্টক এক্সচেঞ্জ, স্থাপনাসহ বিভিন্ন লাভজনক খাতে বিনিয়োগ করে থাকে।
যদিও তহবিল ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ইয়াওয়ার সাঈদ বলছেন, বাংলাদেশে এখন কোন তহবিল বা ফান্ড বিনিয়োগ করে ভালো রিটার্ন পাওয়ার সুযোগ অনেক সীমিত হয়ে এসেছে।

‘’কিন্তু এখন আমরা আশা করতে পারি, এটা যদি প্রফেশনালি ম্যানেজ করা হয় এবং এটাকে ইন্ডিপেনডেন্ট রাখা হয়, অর্থাৎ ইচ্ছে হলো আর সরকার এখান থেকে টাকা নিয়ে গেল, এরকম ঘটনা যদি না ঘটে, তাহলে আমি মনে করি এটা একটা ভালো উদ্যোগ হবে।‘’

বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু এখন ৭৩ বছর। ২০৩১ সালের মধ্যে দেশে দুই কোটির বেশি মানুষের বয়স হবে ৬০ এর উপরে।
বর্তমানে বাংলাদেশে ৬৫ বছরের উপরে দরিদ্র বয়স্কদের ৫০০ টাকা করে মাসিক ভাতা দেয় সরকার।
তবে ৬৫ বছরের উপরে ৪০ শতাংশের বেশি মানুষ কোন ধরনের পেনশন ও বয়স্ক ভাতা কিছুই পান না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বের অনেক দেশে এরকম উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কোন কোন দেশ এটার ভালো ব্যবস্থাপনা করেছে, আবার কোন কোন দেশ এই তহবিল থেকে অন্য কাজে টাকা খরচ করে পরে ঠিকমতো আর দিতে পারছে না।

‘’যদি মনে করা হয় যে, এখানে অনেক টাকা জমে গেছে, এটাকে অন্য কোন কাজে লাগাই, তাহলে নিরাপত্তা বা আস্থার ব্যাপারটা চলে যাবে। যে উদ্দেশ্য নিয়ে ফান্ডটা তৈরি করা হচ্ছে, যাদের আর্থিক সামাজিক নিরাপত্তা দেয়ার জন্য, সেটাই যেন মুখ্য থাকে। সেখান থেকে সরে আসলে বিপদের আশঙ্কা আছে,’’ তিনি বলছেন।

বাংলাদেশের প্রথম প্রাইভেট মিউচুয়াল ফান্ড প্রবর্তনকারী প্রতিষ্ঠান এইমস অব বাংলাদেশের এই কর্মকর্তা মনে করেন, এই তহবিলকে জনপ্রিয় করে তোলাও সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে।

‘’কিন্তু আমি মনে করি, এরকম একটি তহবিল থাকা দরকার। কারণ প্রাইভেট সেক্টরের চাকরিজীবীদের জন্য অবসরে গেলে আর্থিক কোন নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। সেটাকে যদি অ্যাড্রেস করা যায়, তাহলে সবমিলিয়ে একটি ভালো তহবিল হয়ে উঠতে পারে,’’ তিনি বলছেন।

গত অগাস্ট মাসে যখন প্রথম এই বিলটি সংসদে উত্থাপন করা হয়, তখন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তাফিজুর রহমান বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, ‘’এখানে তো বড় আকারের একটা ফান্ড হবে। সেটা কীভাবে ব্যবহার করা হবে, কীভাবে বিনিয়োগ করা হবে, সেটার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।‘’
তিনি বলেছিলেন, এই পেনশন তহবিলের কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে।
প্রথমত, পুরো ব্যবস্থাকে ডিজিটাল প্লাটফর্মের মাধ্যমে নজরদারি করা।
দ্বিতীয়ত, যে কর্তৃপক্ষ থাকবে, তারা যাতে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত ঠিকভাবে নিতে পারেন সেটা দেখা।
তৃতীয়ত, স্বচ্ছতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

সর্বজনীন পেনশন কী?
সংসদে পাশ হওয়া আইনে বলা হয়েছে, সামাজিক নিরাপত্তা প্রদান, বেকারত্ব, ব্যাধি, পঙ্গুত্ব বা বার্ধক্যজনিত কারণে নাগরিকদের সরকারি সাহায্য দেয়া, বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে এই সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করা হচ্ছে।
এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে শুধুমাত্র সরকারি, আধা-সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী পেনশন সুবিধা পেয়ে থাকেন।
এই আইনের মাধ্যমে যেসব বেসরকারি চাকরিজীবী কোনরকম পেনশন সুবিধা পান না, তাদের পেনশনের আওতায় আনার চেষ্টা করা হবে। বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশিরাও এর অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন।
এজন্য এই তহবিলে স্বেচ্ছায় নিবন্ধন করে মাসিক বা ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে চাঁদা দিতে হবে।
অন্তত ১০ বছর চাঁদা দিলে এবং বয়স ৬০ বছর পূর্তিতে পেনশন তহবিলে জমা ও মুনাফার বিপরীতে তিনি আজীবন পেনশন পাবেন।

পেনশন তহবিলে সরকার কী পরিমাণ টাকা দেবে, তা আইনে পরিষ্কার নয় বলে আপত্তি তুলেছেন বিরোধীরা

আইনে বলা হয়েছে, সরকারি অনুদান, নাগরিকদের চাঁদা, বিনিয়োগকৃত অর্থের মুনাফা, প্রতিষ্ঠানসমুহের অংশগ্রহণের চাঁদা, ইত্যাদি নিয়ে পেনশন তহবিল গঠিত হবে। এক বা একাধিক ব্যাংক, পোস্ট অফিস সমূহ এই পেনশন তহবিলের চাঁদা আদায়ের সম্মুখ অফিস হিসাবে কাজ করবে।

Leave A Reply

Your email address will not be published.